ইন্দ্রের সুধাপান - হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় - কবিতাবলী

 ১


একদিন দেব দেবপুরন্দর,

বামে শচীসতী নন্দন ভিতর,

বলিল গন্ধৰ্ব্ব সখারে ডাকি;–

যাও চিত্ররথ, সুধাভাণ্ড ভরি

আন ত্বরা করি পীযূষ লহরী,

আন বাদিত্রবাদকে ডাকি।

আন বাদিত্র সুধাতরঙ্গে,

যত দেবগণ বলিল রঙ্গে,

অমর মাতিল সুরেশ সঙ্গে।



সুবৰ্ণ মঞ্চেতে সুর আখণ্ডল,

চারিদিকে যত অমরের দল,

বিজলীর মত করে ঝলমল,

শোভে পারিজাত হার গ্রীবাতে;


বামে দৈত্যবালা রূপে করে আল,

কোথা যে চঞ্চল তড়িত উজ্জ্বল,

কোথা বা উমার রূপ নিরমল?

পলকে পারে সে জগতে ভুলাতে।


আহা মরি মরি কিবা ভাগ্যধর,

যার কোলে হেন নারী মনোহর,

কত সুখ তার হয় রে।


বীর বিনা আহা রমণীরতন,

বীর বই আর রমণীরতন,

বীর বিনা আহা রমণীরতন,

কারে আর শোভা পায় রে!


(চিতেন[১])


আহা মরি মরি কিবা ভাগ্যধর,

গাহিল যতেক কিন্নরী কিন্নর,

কত সুখ তার হয় রে;


বীর বিনা আহা রমণীরতন,

বীর বই আর রমণীরতন,

বীর বিনা আহা রমণীরতন

কারে আর শোভা পায় রে।



এলো চিত্ররথ মনোরথ গতি,

স্বর্ণপাত্রে সুধা, সঙ্গে বিদ্যারথী,[২]

উঠিল সুরব “জয় শচীপতি”

অমর মণ্ডলী মাঝেতে;

দেব পুরন্দর দেবদল সহ,

সুধা, সোমরস পিয়ে মুহমুহ,

গন্ধে আমোদিত মারুত প্রবাহ,

গগন কাঁপিল বেগেতে—


বায়ু মাতোয়ারা, রবি, শশী, তারা,

অরুণ, বরুণ, দিক্‌পাল যারা,

সবে মাতোয়ারা সুধা পানেতে।

হ’লো ভয়ঙ্কর কাঁপে চরাচর

আকাশ, পাতাল, মহী, মহীধর,

জলধি হুঙ্কারে বেগেতে।


( চিতেন )


বায়ু মাতোয়ারা রবি, শশী, তারা,

অরুণ, বরুণ, দিক্‌পাল যারা,

সবে মাতোয়ারা সুধা পানেতে।



বসিয়ে উন্নত আসন উপরে,

গুণী বিশ্বাবসু বীণা নিল করে,

মেঘের গরজে গভীর ঝঙ্কারে,

মোহিত করিল অমরগণে;

দেবাসুর রণ গাহিতে লাগিল,

কিরূপে অসুরে অমরে নাশিল,

কিরূপে ইন্দ্র দেবরাজ হ’লো,

শুনাইল বীণা বাজায়ে ঘনে।


“পুলোমদুহিতা তোমারি গৃহীতা,

ওহে দেবরাজ তুমিই দেবতা;

রণে পরাজয় করি বাহুবলে,

এ অমরপুরী নিলে করতলে,

সমুদ্র মথিয়া অমৃত লভিলে,—

অহে দেব তব অসাধ্য ক্ষমতা।”

হ’লে প্রতিধ্বনি—“পুলোমদুহিতা,

অহে দেবরাজ তোমারি গৃহীতা;”—


ঘন ঘন ঘোর সুগভীর স্বরে,

কাননে, বিপিনে, নদী, সরোবরে,

উঠিল নিনাদি যতেক দেবতা।

ভাবে গদ গদ মুদিত নয়ন,

উঠিয়া গরজি গরজি সঘন

ছাড়িল হুঙ্কার দনুজঘাতা।


( চিতেন )


হ’লো প্রতিধ্বনি,—“পুলোম দুহিতা,

অহে দেবরাজ তোমারি গৃহীতা”—

ঘন ঘন ঘোর সুগভীর স্বরে,

কাননে, বিপিনে, নদী, সরোবরে,

উঠিল নিনাদি যতেক দেবতা।



অতি সুললিত মৃদু মধুস্বরে,

আবার গাহক বীণা নিল করে,

মজাইল সুরললনা।

“দেখ দেখ চেয়ে নাগরের বেশে,

চোক্ ঢুলু ঢুলু আসে হেসে হেসে,

আড়ে অাড়ে কথা নাহি অভিমান,

সদা আশুতোষ খুলে দেয় প্রাণ,

ওরে সুধা তোর নাই তুলনা।


সদা সেবে যারা সোমরস সুধা

ক্ষোভ লোভ শোক থাকে না ক্ষুধা,

রণজয়ী যেই সুধাপায়ী সেই,

শূর বিনে সুধা-স্বাদ জানে না।


(চিতেন)


“সুধার প্রেমেতে বাজ্‌রে বীণা,

বল্‌ সুধা বই ধন্‌ চাহিনা,

অমন মধুর নাই পিপাসা !

সুধা কিবা ধন সুধা সে কেমন,

সাধক বিনে কি জানিবে চাষা।”


(৬)


দৈত্য অরিদল দম্ভে কোলাহল

করে আস্ফালন করিল কত,

মত্ত মধুপানে দিতিসুতগণে

কি রূপে কোথায় করেছে হত।


তখন আবার বীণা-বাদ্যকর

বীণা নিল করে, সকরুণ স্বরে,

অমর দৰ্প করিল চূর ;

আরক্ত লোচন ঘন গরজন;

ক্রমে ক্রমে সব হ’লো অদর্শন,

স্তব্ধ হইল অমরপুর।


সকরুণ স্বরে বীণা করে ধরে,

গাহিল,—“যখন প্রলয় হবে,

যখন ঈশান হর হর বোলে,

বাজাবে বিষাণ ঘন ঘোর রোলে,

জলে জলম্ময় হবে ত্রিভুবন,

না রবে তপন শশীর কিরণ,

জগত মণ্ডল কারণ বারিতে,

ছিঁড়িয়া পড়িবে ত্রিলোক সহিতে,

তখন কোথা এ বিভব রবে ।

এই সুরপুরী এ সব সুন্দরী

এ বিপুল ভোগ কোথায় যাবে!”—


অতি ক্ষুণ্ণমন যত দেবগণ,

ঘন ঘন শ্বাস করে বিসর্জ্জন,

ভাবিয়ে অধীর প্রলয় যবে ;

এই সুরপুরী এসব সুন্দরী

এ বিপুল ভোগ কোথায় রবে !


(চিতেন)


এ বিপুল ভোগ কোথায় রবে,

বলিয়া কিন্নর গাহিল সবে,




জগত মণ্ডল কারণ বারিতে,

ছিঁড়িয়া পড়িবে ত্রিলোক সহিতে,

তখন কোথা এ বিভব রবে!



গুণী বিশ্বাবসু সঙ্গীতের পতি,

বীণা যন্ত্রে পুনঃ মধুর ভারতী,

গাহিতে লাগিল প্রেমের গাথা;

বিলাপ ঘুচিল প্রেম উপজিল

রসে ডগমগ তনু শিহরিল।

একি সুত্রে প্রেম করুণ গাঁথা।


মৃদুল মৃদুল তাজ বে তাজ,[৩]

মৃদুল মৃদুল নও বে নও,

বাজিতে লাগিল মধুর বোলে;

শ্রবণে শীতল যতেক শ্রোতা।

“সংগ্রামে কি সুখ, সকলি অসুখ,

দিন রাত নাই প্রাণ ধুক ধুক্‌,

মান মর্য্যাদা কথার কথা।


ঘোড়া দড়বড়ি, অসি ঝনঝনি,

কাটাকাটি, গোল, তীর স্বন্‌স্বনি,

কাণে লাগে তালা করে ঝালাপালা,

দেহ হয় আলা সমর-স্রোতে ;

গতি অবিরাম নাহিক বিরাম,

সমরে কি সুখ নারি বুঝিতে।


চির দিন আর দনুজ সংহার

করে কত ভার সহিবে দেব;

বামে শচীসতী হের সুরপতি,

কর সুখভোগ রাখ বুকেতে।”—


বাখানিল যত কিন্নর কিন্নরী,

বাখানিল যত স্বর্গ-বিদ্যাধরী,

বাখানিল দেবগণ পুলকে।


রতিপতি জয় হলো সুরপুরে

ললিত মধুর বীণার সুরে;

সঙ্গীতের জয় হলো ত্ৰিলোকে।


স্মরে জর জর দেহ থর থর,

হেরে ঘন ঘন দেব পুরন্দর,

হৃদয়ে বামারে রাখিতে চায়;


নিমেষে হেরিছে নিমেষে ফিরিছে

নিমেষে নিশ্বাস বহিছে তায়।

শেষে পরাজিত অচেতন চিত,

শচী বক্ষস্থলে ঘুমায়ে রয়।


( চিতেন)


গাহিল কিন্নর,—“স্মরে জর জর

দেব পুরন্দর হলো পরাজয়,

নিমেষে হেরিছে নিমেষে ফিরিছে,

নিমেষে নিশ্বাস বহিছে তায়।

শেষে পরাজিত অচেতন চিত

শচী বক্ষস্থলে ঘুমায়ে রয়।”



“বাজ্‌ রে বীণা বাজ্‌ রে আবার,

ঘন ঘোর রবে বাজ এইবার,

আরো উচ্চতর গভীর সুরে;

যাক্‌ দূরে যাক্‌ কামের কুহক

মেঘের ডাকে ডাক্ রে পূরে!

অহে সুররাজ ছিছি একি লাজ,

দেখ দেখ অই দনুজ সমাজ,

রণসাজ করে আসিছে ফিরে;


শিরে ফণীবাঁধা করে উল্কাপাত,

কর সুরনাথ দনুজ নিপাত,

দেখ চরাচর কাঁপিছে ডরে।


জলদ নিনাদে করে হুহুঙ্কার,

এ অমরপুরী করে ছারখার,

পূরণ আহুতি করিবে এবে।

কর দম্ভ চূর, বজ্র ধর শূর,

রাখ হে ব্রহ্মাণ্ড, বাঁচাও দেবে।”


শুনে বজ্রধর বেগে বজ্র ধরে,

কড় কড় ধ্বনি গরজে অম্বরে,

ভয়ে হিমগিরি টলিল।

তখন উল্লাসে, বিদ্যারথী হেসে,

বীণাযন্ত্র পাশে রাখিল।


(চিতেন)


“বেগে বজ্রধর,” গাহিল কিন্নর,

“কড় কড় নদে গরজে অম্বর,

ভয়ে হেমগিরি টলিল।

তখন উল্লাসে বিদ্যারথী হেসে

বীণাযন্ত্র পাশে রাখিল।”


————–

১. ইংরাজিতে এইরূপ স্থলে কোরস্ বলে। ঐ শব্দের অনুরূপ ঠিক অন্য কোন শব্দ না পাওয়ায় চিতেন লেখা হইয়াছে।

২. এই অমর গায়কের আর একটী নাম বিশ্বাবসু।

৩. দেবতারই সঙ্গীতের সৃষ্টিকর্ত্তা, সুতরাং এই লক্ষ্ণৌই সুরও দেবতাদিগের মধ্যে প্রচলিত থাকা সম্ভব।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad

Ads Section