অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় রচনাসংগ্রহ (নন-ফিকশন) | Rachana samaghra by AKSHAY KUMAR MOITRA
অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় রচনাসংগ্রহ (নন-ফিকশন)
সম্পাদকের উৎসর্গ : বাঙালির গৌরবময় বিস্মৃত অতীত প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসু পাঠককে
প্রাককথন
ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকের জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকদের মধ্যে এক উজ্জ্বল নাম অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়। তবে শুধু ঐতিহাসিক বললে ভুল হবে, তিনি ছিলেন একাধারে সাহিত্যিক, প্রত্নতাত্ত্বিক, শিল্পরসিক, নাট্যশাস্ত্রবিদ ও বাগ্মী, যিনি বাঙালির ইতিহাসকে সাম্রাজ্যবাদী লেখকদের মসিলিপ্ত করার অসাধু উদ্যোগকে খণ্ডন করে ন্যায়নিষ্ঠ বিচারকের মতো যুক্তির কাঠগড়ায় দাঁড় করান, সত্য নয় অথচ সত্য হিসেবে অতীত ঘটনাকে পরিগণিত করার বিজাতীয় প্রয়াস যুক্তিবাণে অপনোদন করে জাতীয় কলঙ্ক মোচনে সচেষ্ট হন এবং ইউরোপীয় বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অবলম্বন করে সংস্কার-বর্জিত চিন্তার আলোকে বঙ্গদেশে ইতিহাস আলোচনার প্রবর্তন করেন। বন্ধুপ্রতিম এই ঐতিহাসিক সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ তাই নির্দ্বিধায় লিখেছিলেন, ‘বাঙ্গালা ইতিহাসে তিনি যে স্বাধীনতার যুগ প্রবর্তন করিয়াছেন সেজন্য তিনি বঙ্গ-সাহিত্যে ধন্য হইয়া থাকিবেন। এহেন মনীষীর জন্মসার্ধশত বছরে এ সংকলন তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদিত তর্পণ। সিরাজদ্দৌল্লা, মিরকাশিম-এর মতো একাধিক গ্রন্থপ্রণেতা অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় বহুবিধ বিষয়কে কেন্দ্র করে অসংখ্য প্রবন্ধ রচনা করেছেন যা ছড়িয়ে আছে। সমকালীন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় যার অধিকাংশই আজ আর সহজলভ্য নয়। সে-সব দুর্লভ পত্রিকার জরাজীর্ণ পাতার অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা অক্ষয়-সৃষ্টিকে বিস্মৃতির অন্তরাল থেকে উদ্ধার করে সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রেরণায় এ গ্রন্থের আবির্ভাব।
বঙ্গভূমি ও বাঙ্গালী
মানব-সভ্যতার আদি উদ্ভবক্ষেত্র
পূর্ব দিকে প্রশান্ত মহাসাগর;–অপর দিকে ভূ-মধ্যসাগর, এই দুইটি সুবিখ্যাত “তোয়া-নিধির” অন্তর্বেদি রূপে যে বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগ দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা ইউরোপীয় সভ্য-সমাজে “প্রাচী” নামে উল্লিখিত হইয়া আসিতেছে। এই প্রাচী নিকট ও দূর নামক দুই জ্বভাগে বিভক্ত,–যাহা নিকট, তাহার সহিত ভূ মধ্যসাগর-তীরের গ্রীস, মিশর প্রভৃতি দেশের, এবং বহু সংখ্যক দ্বীপপুঞ্জের সম্বন্ধ এত নিকট যে, তাহাদিগকেও কেহ বর্ণনা করিবার জন্য “প্রাচী” সংজ্ঞা দান করিয়া থাকেন। যাহা ‘দূর প্রাচী” নামে উল্লিখিত, তাহার মধ্যেও বহু সংখ্যক দ্বীপ সন্নিবিষ্ট।
মানব-সভ্যতার আদি উদ্ভব-ক্ষেত্র কোথায়, তৎসম্বন্ধে মানব সমাজ বহু কাল হইতে তথ্যানুসন্ধান করিয়া আসিতেছে। আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যসমাজ অনেক। দিন পর্যন্ত রোম এবং গ্রীস এবং কখন কখন মিশর দেশকে সেই আদি উদ্ভব-ক্ষেত্র বলিয়া বর্ণনা করিবার জন্য চেষ্টা করিয়া, সকল কৌতূহল চরিতার্থ করিতে না পারিয়া, এখনও তথ্যানুসন্ধান চেষ্টায় বিরত হইতে পারে নাই। এখনও নিত্য নূতন অধ্যবসায়, নিত্য নতুন তথ্যানুসন্ধান চেষ্টায় অনেক নূতন স্থানে ভূগর্ভ খননে নানা রূপ ক্লেশ স্বীকার করিতেছে। ইহাতে পুরাতত্ত্ব জ্ঞানের পূৰ্ব্বপরিচিত সংকীর্ণ সীমা ক্রমে অধিক হইতে অধিকতর সম্প্রসারিত হইয়া, বিদ্বৎসমাজকে নিকট হইতে দূর প্রাচীর দিকে আকর্ষণ করিতে আরম্ভ করিতেছে। এখন প্রাচ্য তত্ত্ব মানবতত্ত্বের প্রধান পরিচয়-ক্ষেত্র বলিয়া সৰ্ব্বত্র উত্তরোত্তর অধিক শ্রদ্ধা লাভ করিতেছে।
বৌদ্ধধর্ম
কপিলাবস্তু
বৌদ্ধধর্মের তিরোভাবের সঙ্গে ভারতবর্ষ হইতে কপিলাবস্তুর নাম পৰ্য্যন্তও বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে। এখন আর কপিলাবস্তু নামে কোনো রাজ্য বা রাজধানী আর কপিলবস্তু নামে কোন রাজ্য বা রাজধানী দেখিতে পাওয়া যায় না। অতি পুরাতন দেশ বলিয়া, ভারতবর্ষের গ্রাম নগর ধবংসপ্রাপ্ত হইয়াছে, অন্য কোন দেশে তত ধবংসলীলার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায় না। যদুপতির মথুরাপুরী, রঘুপতির উত্তর কৌশলা, কোথায় বুদ্বুদবৎ বিলীন হইয়া গিয়াছে;–সে কথা ক্রমে প্রবাদমাত্রে পরিণত হইয়াছে। যদুপতি বা রঘুপতি দৃষ্টান্ত মাত্র; কত নরপতির কত সমুন্নত সৌধশিখর ধূলিপরিণত হইয়াছে, তাহার তথ্যনির্ণয় করা অসম্ভব।
অগণ্য পুরাকীৰ্ত্তির সন্ধান প্রাপ্ত হইয়া পুরাতত্ত্ববিৎ পণ্ডিতমণ্ডলী কখন একদেশ মাত্ৰ পৰ্যালোচনা করিয়া, কখন বা কল্পনা জল্পনার সহায়তা গ্রহণ করিয়া ঐতিহাসিক ভ্রমপ্রমাদে পতিত হইয়া থাকেন। কপিলবস্তুর স্থাননির্দেশে এরূপ অনেক ভ্রমপ্রমাদ প্রচলিত হইয়াছিল। ভূগর্ভের নিভৃত নিকেতনে কতবার কপিলবস্তুর কীৰ্তিচিহ্ন আবিষ্কৃত হইল; কতবার তাহার ভ্রমপ্রমা অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপাদিত হইয়া গেল! তথাপি ঐতিহাসিক আবিষ্কারের অদম্য অধ্যবসায় পরিশ্রান্ত না হইয়া, আবার অনুসন্ধান কার্যে ব্যাপৃত হইয়াছিল। তাহার ফলে আমরা আবার একখানি বিচিত্র গ্রন্থ প্রাপ্ত হইয়াছি।
বঙ্গে তুর্কী আক্রমণ
বক্তিয়ার খিলিজির বঙ্গ-বিজয়
সচরাচর যে সকল গ্রন্থ বাঙলার ইতিহাস বলিয়া বিদ্যালয়ে অধ্যাপিত হইয়া থাকে, তাহাতে দেখিতে পাওয়া যায়, ১২০৩ খ্রিস্টাব্দে পাঠান-সেনাপতি বক্তিয়ার খিলিজি সপ্তদশ অশ্বারোহী লইয়া বাঙলার রাজধানী নবদ্বীপনগরে উপনীত হইবামাত্র, নবদ্বীপাধিপতি বৃদ্ধ লাক্ষ্মণ্য সেন রাজ্য ও রাজধানী পরিত্যাগ করিয়া, অন্তঃপুর হইতে ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করেন।
এই কাহিনী বাঙালীর পুরাতন সাহিত্যে দেখিতে পাওয়া যায় না। কিন্তু ইহা আধুনিক বঙ্গসাহিত্যের পদ্যে-গদ্যে গল্পে-উপন্যাসে পাঠকসমাজে সুপরিচিত হইয়াছে। বঙ্গদেশের পুরাতন জনশ্রুতি হইতে এই কাহিনী গৃহীত হইলে, পুরাতন সাহিত্যেও ইহার আভাস থাকিত। অন্য কোনো প্রমাণ না থাকিলেও, এ দেশে পুরাতন জনশ্রুতি বলিয়া ইহাকে ঐতিহাসিক সত্য বলিয়া মানিয়া লইতে হইত।
কোন সময়ে কি সূত্রে এই কাহিনী বঙ্গসাহিত্যে প্রথমে স্থান প্রাপ্ত হয়, তাহা নির্ণয় করা কঠিন নহে। যাঁহারা বঙ্গসাহিত্যের ইতিহাস আলোচনা করিয়া দেখিবেন, তাঁহারা সকলেই স্বীকার করিবেন,–আধুনিক বঙ্গবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হইয়া তাহাতে ইতিহাস অধ্যাপিত হইবার পূর্বে এই কাহিনী বঙ্গসাহিত্যে প্রবেশলাভ করে নাই। প্রথমে বিদ্যালয়ে, পরে শিক্ষিত সমাজে এবং ধীরে ধীরে জনসাধারণের মধ্যে এই কাহিনী ক্রমশ বিস্তৃতিলাভ করিয়াছে।
উত্তরবঙ্গের পুরাকীর্তি
প্রত্নবিদ্যা
পুরাণে প্রতন-প্রত্ন পুরাতন-চিরন্তনাঃ।
আজ যাহা পুরাতন, একদিন তাহা নূতন ছিল। আজ যাহা নূতন, একদিন তাহা পুরাতন হইবে। তথাপি নূতন-পুরাতনের সম্বন্ধ-সূত্র বিচ্ছিন্ন হইবার নহে। সুতরাং পুরাতন যতই পুরাতন হউক না কেন, তাহার পরিচয় লাভের প্রয়োজন আছে। মানবমন শিক্ষায় ও সভ্যতায় যতই বিস্তৃতি লাভ করে, পুরাতনের পরিচয় লাভের জন্য ততই লালায়িত হইয়া থাকে। পুরা-প্রীতি,–যাহা চলিয়া গিয়াছে তাহার অনুসন্ধান-লালসা,–সভ্য মানবের পক্ষে স্বাভাবিক। কেহ জ্ঞানলাভের আশায়, কেহ কৌতূহল চরিতার্থ করিবার আকাঙ্ক্ষায়, কেহ বা কেবল পুরাতনের স্বপ্নমোহে, পুরাতনের পরিচয় লাভের চেষ্টা করিয়া থাকেন। অনেকে মনে করেন, –তাহা অতি সহজসাধ্য ব্যাপার। প্রকৃত প্রস্তাবে তাহা সহজসাধ্য বলিয়া কথিত হইতে পারে না।
যে বিদ্যার সাহায্যে পুরাতনের প্রকৃত পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যাইতে পারে, তাহার নাম প্রত্নবিদ্যা। অল্পকাল পূৰ্ব্বেও তাহা একটি উল্লেখযোগ্য বিদ্যা বলিয়া স্বীকৃত হইত না। যে কেহ, যে কোন ভাবে, তাহার আলোচনা করিত। এখন দিন ফিরিয়াছে; জ্ঞানানুরাগ বাড়িয়াছে; এখন আর যে কেহ যে কোন ভাবে পুরাতনের আলোচনা করিতে সাহস করে না; –এখন কোন কোন স্থানে তাহার যথাযোগ্য অধ্যয়ন-অধ্যাপনারও সূত্রপাত হইয়াছে। সভ্য-সমাজের সুধীবৃন্দ বুঝিয়াছেন, অধিকাংশ বিদ্যার আলোচ্য বিষয় বাহ্যবস্তু; কেবল প্রত্নবিদ্যারই আলোচ্য বিষয় পৃথক। বাহ্যবস্তুর সাহায্যে মানব-প্রকৃতির ও মানব-মনের ক্রমবিকাশের মূল সূত্রের অনুসন্ধান করাই তাহার প্রকৃত লক্ষ্য।
তাম্রশাসন সমালোচনা
তাম্রশাসনের ইতিহাস
বিগত জানুয়ারি মাসের “কলিকাতা রিভিউ” পত্রে শ্রীযুক্ত শরচ্চন্দ্র মিত্র মহাশয় ‘তাম্রশাসনের ইতিহাস” সম্বন্ধে একটি সুলিখিত প্রবন্ধ প্রকটিত করিয়াছেন। এ পৰ্যন্ত ভারতবর্ষের নানা স্থানে নানা সময়ে যতগুলি খোদিত তাম্রফলক আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহার সংখ্যা নিতান্ত অল্প নহে। তাহার কতক এদেশে এবং কতক বিলাতে নানা স্থানে রক্ষিত হইয়াছে। সকলগুলির পাঠ ব্যাখ্যা ও প্রতিকৃতি এ পৰ্য্যন্ত প্রকাশিত হয় নাই; যতগুলি প্রকাশিত হইয়াছে তাহারও যথারীতি সমালোচনা হইয়াছে বলিয়া বোধ হয় না। কোনো স্থলে কেবল মূল, কোথায়ও বা অনুবাদ এবং ক্কচিৎ যৎসামান্য টীকা মাত্রই প্রকাশিত হইয়াছে; তাহাতে সমস্ত জ্ঞাতব্যতর অবগত হওয়া যায় না। এই সকল তাম্রশাসনে আমাদের দেশের যে সকল ঐতিহাসিক তথ্য নিহিত রহিয়াছে তাহা বিস্তৃতরূপে আলোচিত হওয়া আবশ্যক।
মিত্র মহাশয় লিখিয়াছেন : ১ রাজানুশাসন ভিন্ন প্রজাবর্গের দান বিক্রয়াদি ব্যাপারও তাম্রফলকে উত্তীর্ণ হইত; ২ হিন্দু বা বৌদ্ধগণ ভিন্ন মোসলমানেরা তাম্রফলকের ব্যবহার করিতেন বলিয়া প্রমাণ পাওয়া যায় না; মোসলমান নরপতিবর্গের একখানি তাম্রশাসনও আবিষ্কৃত হয় নাই; ৩ তাম্রপট্ট ভিন্ন পিত্তলাদি ধাতুপত্রও এই উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হইত। এই কয়েকটি কথার উপর নির্ভর করিয়া মিত্র মহাশয় সিদ্ধান্ত করিয়াছেন, “মোসলমানাধিকারের পূর্বে ভারতবর্ষে উৎকৃষ্ট কাগজ প্রস্তুতের প্রণালী অজ্ঞাত ছিল, তজ্জন্যই বোধ হয় ধাতুফলক ব্যবহৃত হইত।”
ধীমানের ভাস্কৰ্য্য
মনের ভাব প্রকাশিত করিবার জন্য মানুষ অনেক রকমের কৌশল বিস্তার করিয়া থাকে। তাহাকে স্থায়িত্ব-প্রদানের আশায় পুরাকালে যে সকল কৌশল অবলম্বিত হইয়াছিল, স্থাপত্য, ভাস্কৰ্য্য ও চিত্র তন্মধ্যে একশ্রেণীর কৌশল বলিয়া কথিত হইতে পারে। তাহাও ভাষা; কেন না, তাহাও “ভাষতে অনয়া লোকঃ”–এই নিরুক্তির অন্তর্গত। সুতরাং পাষাণে যে সকল কারুকাৰ্য্য ও মূৰ্তিচিত্র অঙ্কিত হইত, তাহাকেও ভাষা বলিয়াই গ্রহণ করিতে হইবে। তাহারও ব্যাকরণ আছে, রচনারীতি আছে, অলঙ্কার আছে;-পদ্য গদ্যেরও অসদ্ভাব নাই। যাঁহারা অক্ষরযোজনা করিয়া কথা লিপিবদ্ধ করিয়া গ্রন্থ রচনা করিয়া গিয়াছেন, তাঁহারাই সে কালের একমাত্র কবি ছিলেন না;–যাঁহারা বাটালি চালাইয়া পাষাণফলকে চিত্রাঙ্কন করিয়া গিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যেও অনেকে কবিপদবাচ্য হইবার সম্পূর্ণ উপযুক্ত। তাঁহাদের নাম গোত্র বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে;–অনেক স্থলে তাঁহাদের কাব্যকাহিনীও বিলুপ্ত হইয়া পড়িয়াছে। কিন্তু এখনও তাঁহাদের ও তাঁহাদের এই শ্রেণির কাব্যসৌন্দর্য্যের কিছু কিছু নিদর্শন বর্তমান আছে।
আমাদের চতুষ্পঠীতে “অভিজ্ঞানশকুন্তলে’র বড়ো আদর ছিল না; বরং ‘অনর্ঘরাঘবে”র “প্রবোধচন্দ্রোদয়ের কিছু কিছু আদর থাকিবার পরিচয় টীকা টিপপনীতে দেখিতে পাওয়া যায়। আমাদের চতুম্পাঠীর ছাত্রগণের মধ্যে একটি প্রবচন প্রচলিত ছিল :
অষ্টাদশ শতকের বাংলা
কলিকাতা অবরোধ উদ্দেশ্য
The Subadar had a wish for a triumph, which he thought might be easily obtained; and he was greedy of riches, with which, in the imagination of the natives, Calcutta was filled. –Mill’s History, III, 147.
বাঙ্গালার ইতিহাসে দেখিতে পাওয়া যায়,–১৭৫৬ খৃষ্টাব্দের জুন মাসে সিরাজদ্দৌলা কর্তৃক কলিকাতা অবরুদ্ধ হইয়াছিল। অবরুদ্ধ হইয়াছিল, তাহা সত্য কথা। কিন্তু অবরুদ্ধ হইয়াছিল কেন, তাহার সকল কথা এখনও ইতিহাসে স্থান লাভ করিতে পারে নাই।
যে সকল কাগজ পত্রে তাহার পরিচয় লাভের উপায় ছিল, সকলের পক্ষে তাহার সন্ধান লাভের সম্ভাবনা ছিল না। সুতরাং সেকালের ইতিহাসে অনেক অনুমানের ছড়াছড়ি হইয়াছিল। তখনও ইতিহাস ইতিহাসরূপে লিখিত হইবার জন্য ব্যগ্র হয় নাই। কারণ, তখনও ইতিহাস ইতিহাস নহে; আখ্যায়িকা। সুতরাং সুপ্রসিদ্ধ ইতিহাস-লেখক জেমস মিলও অবলীলাক্রমে লিখিয়াছেন :
সুবাদারের মনে মনে একটা বিজয়োৎসবের সখ জন্মিয়াছিল; তিনি ভাবিয়াছিলেন, তাহা সহজেই সুসম্পন্ন হইবে; তিনি বড় অর্থলোলুপ ছিলেন; আর দেশের লোকেরও বিশ্বাস ছিল যে কলিকাতা বহু ধনরত্নে পরিপূর্ণ।
কলিকাতা আক্রমণের এই উদ্দেশ্যটি মিলের ইতিহাসে স্থান লাভ করিয়া অমর হইয়া রহিয়াছে, এবং সিরাজদৌলার খামখেয়ালীর একটি প্রধান দৃষ্টান্ত বলিয়াও পরিচিত হইয়া পড়িয়াছে। সেকালের ইংরাজ-লেখকগণ সিরাজ-চরিত্র সম্বন্ধে অনেক বিস্ময়কর জনরবে আস্থা স্থাপন করিতে ইতস্ততঃ করিতেন না; সুতরাং মিলের এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত তাঁহাদিগকে বিস্ময়াবিষ্ট করিতে পারে নাই।
বস্ত্রশিল্প
পট্টবস্ত্র
রেশমতত্ত্বঞ্জ ফরাসি পণ্ডিত মসিয় রভোনানাদিদেশের রেশমশিল্পের যে সকল গুহ্যতত্ত্ব প্রকাশিত করিয়াছেন, তৎপ্রতি বাঙ্গালীর দৃষ্টি আকর্ষণ করিবার জন্য, কৃষিতত্ত্ববিৎ সুপণ্ডিত নিত্যগোপাল মুখোপাধ্যায় মহাশয় যত্নের ত্রুটি করেন নাই; কিন্তু তাহার চেষ্টা সফল হইয়াছে কি না সে বিষয়ে সমূহ সন্দেহ!
বাঙ্গালী শিল্প বাণিজ্যের জন্যই পুরাকালে সমধিক খ্যাতি লাভ করিয়াছিল। সে খ্যাতি এখন ক্রমেই জনশ্রুতিমাত্ৰে পৰ্য্যবসিত হইতেছে;–যাহাদের শিল্পদ্রব্যের সন্ধান লাভ করিয়া ইউরোপীয় বণিক সম্প্রদায় দলে দলে এদেশে উপনীত হইত, তাহারাই এখন অন্নাভাবে হায় হায় করিয়া চাকরীর আশায় দেশে দেশে ছুটিয়া বেড়াইতেছে!
কেন এমন হইল, তাহার কথা কয়জন বাঙ্গালী চিন্তা করিয়া থাকেন? আমাদের আন্দোলনস্পৃহা বিবর্ধিত হইয়াছে বলিয়া চারিদিকেই জনরব শুনিতে পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের শিল্পবাণিজ্যের অধোগতি হইল কেন,–তাহার জন্য ত দেশব্যাপী আন্দোলন দেখিতে পাই না?
এক সময়ে রেশমের জন্য বাঙ্গালীর নাম দেশ বিদেশে বিখ্যাত হইয়া উঠিয়াছিল; সে শিল্পও এখন যায় যায় হইয়া উঠিয়াছে! কেন এমন হইল, তাহারই যৎকিঞ্চিৎ আলোচনা করিব।
পৃথিবীর সকল দেশেই কিছু না কিছু রেশম উৎপন্ন হইয়া থাকে, এবং সভ্যজনপদের অধিবাসিমাত্রেই কোনো না কোনো আকারে রেশম-শিল্পজাত দ্রব্যাদি ব্যবহার করিয়া থাকেন। সুতরাং একদিকে রেশমের আদর যেমন পৃথিবীব্যাপী, অন্যদিকে রেশম-ব্যবসায়ে প্রতিদ্বন্দ্বীও প্রায় দেশে দেশেই শক্তিশালী হইয়া উঠিতেছে। ইউরোপখণ্ডের রেশম ব্যবসায়ীগণ বৈজ্ঞানিক শক্তিবলে বলীয়ান হইয়া আমাদের রেশম-ব্যবসায়ের ক্ষতি করিতে সক্ষম হইয়াছেন, কিন্তু নূতন শিক্ষা বলিয়া তাঁহারা এখনও আমাদিগকে সম্পূর্ণ পরাজিত করিতে পারেন নাই। আমরা যদি এখন হইতে বৈজ্ঞানিক প্রণালীর অনুসরণ করিতে শিখি, কালে হয়ত আবার আমাদের রেশমশিল্প সর্বোচ্চস্থান অধিকার করিতে পারিবে।
লালন ফকির
লালন ফকিরের সকল কথা ভাল করিয়া জানি না, যাহা জানি তাহাও কিম্বদন্তীমূলক। লালন নিজে অতি অল্প লোককেই আত্মকাহিনী বলিতেন, তাঁহার শিষ্যেরাও বেশী কিছু সন্ধান বলিতে পারেন না। লালন জাতিতে কায়স্থ, কুষ্টীয়ার নিকটবর্তী চাপড়াগ্রামের ভৌমিকেরা তাঁহার স্বজাতীয়। ১০।১২ বৎসর বয়সে বারুণী গঙ্গাস্নান উপলক্ষে মুর্শিদাবাদে যান, তথায় উকট বসন্তরোগে আক্রান্ত হইয়া মুমূর্য দশায় পিতা-মাতা কর্তৃক গঙ্গাতীরে পরিত্যক্ত হন। লালনের মুখে বসন্তচিহ্ন বৰ্ত্তমান ছিল বলিয়া অনেকে এই কাহিনী বিশ্বাস করিয়া থাকেন। শ্মশানশায়ী লালনকে একজন মুসলমান ফকীর সেবাশুশ্রূষায় আরোগ্য করিয়া লালনপালন করেন ও ধর্মশিক্ষা প্রদান করেন। এই ফকিরের নাম সিরাজ সা, জাতিতে মুসলমান। লালনের প্রণীত অনেক গানে এই সিরাজ সা দীক্ষাগুরুর উল্লেখ আছে।
লালনের ধর্মমত অতি সরল ও উদার ছিল। তিনি জাতিভেদ মানিতেন না, হিন্দু মুসলমানকে সমভাবে দেখিতেন ও শিষ্যদিগের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সকল জাতিকেই গ্রহণ করিতেন। লালন হিন্দু নাম, সা উপাধি মুসলমান জাতীয় সুতরাং অনেকেই তাঁহাকে জাতির কথা জিজ্ঞাসা করিত। তিনি কোনো উত্তর না দিয়া কেবল স্বপ্রণীত নিম্নলিখিত গানটি শুনাইতেন :
১ সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে?
লালন ভাবে–জাতির কি রূপ দেখলাম না এই নজরে।
কেউ মালা কেউ তজবী গলায়,
তাইতে ত জাত ভিন্ন বলায়,
যাওয়া কিম্বা আসার বেলায়
জাতের চিহ্ন রয় কার রে?
২ যদি সুন্নত দিলে হয় মোসলমান।
নারীর তবে কি হয় বিধান।
বামন চিনি–পৈতা প্রমাণ,
বামনী চিনি কিসে রে?
পাল সাম্রাজ্যের অধঃপতন
[কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হাউসে প্রদত্ত অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র বক্তৃতার সারাংশ]
খৃষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে বাঙ্গালায় ঘোর ‘মাৎস্য ন্যায়’ (অরাজকতা) উপস্থিত হইয়াছিল। তাহাতে পুনঃ পুনঃ উৎপীড়িত হইয়া, বঙ্গীয় প্রজাবৃন্দ অবশেষে গোপাল নামক এক ব্যক্তিকে রাজপদে বরণ করিয়াছিল। সৰ্ব্ব বিদ্যাবিৎ দয়িতবিষ্ণুর পৌত্র, যুদ্ধবিদ্যাবিশারদ বপটের পুত্র, সমরকুশল গোপালদেব যে রাজবংশের প্রথম রাজা, তাহাই ইতিহাস বিখ্যাত পাল-রাজবংশ। প্রজাপুঞ্জের শক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত এই রাজবংশ অচিরে সমগ্র আর্যাবর্তে সাম্রাজ্য বিস্তার করিয়াছিল। গোপালের পুত্র ধর্মপাল ভোজ, মৎস্য, মদ্র, কুরু, যদু, যবন, অবন্তী, গান্ধার, কীর এবং পঞ্চাল দেশের উপর আধিপত্য লাভ করিয়াছিলেন। তৎপুত্র দেবপাল হিমালয় হইতে বিন্ধ্য, এবং পূর্ব ও পশ্চিম সমুদ্রের মধ্যবর্তী সমুদয় ভূভাগ করপ্রদ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন।
এই দেবপালদেব উকুল-কুল উৎকিলিত করিয়া, হূণগৰ্ব্ব খবৰ্বীকৃত করিয়া, এবং দ্রবিড়-গুর্জরনাথ-দর্প চূর্ণকৃত করিয়া, দীর্ঘকাল পর্যন্ত সমুদ্র মেখলাভরণা বসুন্ধরা উপভোগ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন।
পালরাজবংশের এই বিস্তৃত প্রভাব অধিককাল স্থায়ী না হইলেও, তাঁহারা দীর্ঘকাল আর্যাবর্তের পূর্বভাগের অধীশ্বর ছিলেন। গোপালের অধস্তন দশম পুরুষে রাজা বিগ্রহপাল (৩য়) যখন মহীপাল (২য়), শূরপাল (২য়) ও রামপাল নামক তিন পুত্র রাখিয়া মৃত্যুমুখে পতিত হন, তখন গৌড়, বঙ্গ ও মগধ পাল রাজগণের অধীন ছিল; কিন্তু মহীপাল রাজ্যলাভ করিবার অনতিকাল পরেই অনীতিক আচরণ আরম্ভ করেন এবং তাঁহার দুই ভ্রাতাকে কারাগারে আবদ্ধ করেন। ইহার ফলে বরেন্দ্রভূমির প্রজাগণ বিদ্রোহী হইয়া, মহীপালকে সিংহাসনচ্যুত ও নিহত করে। এই বিদ্রোহের নায়ক কৈবৰ্ত্তজাতীয় দিবেবাক তাঁহার ভ্রাতা রুদোক ও ভ্রাতুস্পুত্র ভীম যথাক্রমে বরেন্দ্রভূমির শাসনভার গ্রহণ করিয়াছিলেন।
রবীন্দ্রনাথকে লেখা অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র পত্রাবলি
বাঙ্গালা ইতিহাসে তিনি [অক্ষয়কুমার] যে স্বাধীনতার যুগ প্রবর্তন করিয়াছেন সেজন্য তিনি বঙ্গসাহিত্যে ধন্য হইয়া থাকিবেন। –রবীন্দ্রনাথ, ১৩০৫
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এবং বিংশ শতাব্দীর সূচনায় বাংলাদেশের মনীষীসমাজে সাহিত্য শিল্প ইতিহাস ও বিজ্ঞান-চর্চায় এই একটি ভাব প্রবল হইয়া উঠিয়াছিল যে, “ভারতবর্ষের যথার্থভাবে আত্মপরিচয় দিবার সময় আসিয়াছে”, “বিশ্বসভায় ভারতবর্ষের অমরবাণী উচ্চারণ করিবার সময় উপস্থিত’–”বিপুল মানবশক্তি বাংলা সমাজের মধ্যে প্রবেশ করিয়া কাজ আরম্ভ করিয়াছে… এ আমাদের সংকীর্ণতা আমাদের আলস্য ঘুচাইয়া তবে ছাড়িবে। আমাদের মধ্যে বৃহৎ প্রাণ সঞ্চার করিয়া সেই প্রাণ পৃথিবীর সহিত যোগ করিয়া দিবে।”
এই “নবজাতির জন্মসংগীত’-এর প্রধান উদগাতা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ–”আমার তো আশা হইতেছে আমাদের মধ্যে এমন সকল বড়লোক জন্মিবেন যাঁহারা বঙ্গদেশকে পৃথিবীর মানচিত্রের সামিল করিবেন ও এরূপে পৃথিবীর সীমানা বাড়াইয়া দিবেন”–প্রথমযৌবনের এই কল্পনাকে তিনি সাধনা দ্বারা নিজের জীবনে যেমন সার্থক করিয়া তুলিয়াছিলেন, তেমনি বন্ধুসমাজে যেখানেই প্রতিভার দীপ্তি লক্ষ্য করিয়াছেন সকলকেই “পতাকা হস্তে অগ্রসর হইতে” আহ্বান করিয়াছেন –”স্বদেশের আহ্বান প্রত্যহই পরিস্ফুটতর ভাবে ধবনিত হইয়া উঠিতেছে– আপনি যে এই আহ্বানের লক্ষ্য আছেন তাহা আমি কবির চক্ষে দেখিতেছি এবং একদিন যে আপনি সংগ্রাম হইতে ফিরিয়া আসিয়া স্বদেশের ললাটে নূতন যশোমাল্য স্থাপন করিতেছেন তাহাও আমি দেখিতে পাইতেছি”, এবং প্রবল উৎসাহে তাঁহাদের কার্যে প্রেরণা সঞ্চার করিতে উদযোগী হইয়াছেন।*
ধন্যবাদ অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় এর রচনাসংগ্রহ বইটি পড়ার জন্য। আপনার মতামত জানতে আমরা আগ্রহী। কমেন্টে আপনার মূল্যবান মতামতটি জানান।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
0 মন্তব্যসমূহ